ছবি:সংগৃহীত
অসম সাহসী গেরিলা যোদ্ধা, শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের ৫৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রবিবার সকালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির উদ্যোগে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।
এ সময় বক্তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে জগৎজ্যোতি দাসের আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা স্মরণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরার আহবান জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের চারজন শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাঁরা হলেন- শহীদ তালেব, গিয়াস, জগৎজ্যোতি ও আসগর। এদের মধ্যে জগৎজ্যোতি দাস ছিলেন এক কিংবদন্তী গেরিলা যোদ্ধা, যিনি গোটা হাওরাঞ্চলে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ‘দাস পার্টি’ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির সহ-সভাপতি লেখক, গবেষক সুখেন্দু সেন এবং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুর রকিব তারেকসহ অন্য বক্তারা নতুন প্রজন্মের প্রতি আহŸান জানিয়ে বলেন, এই বীরযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। তাঁদের বীরত্বগাঁথা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে তারা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সহকারী অধ্যাপক আহসান শহীদ আনসারী, লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খলিল রহমান, কোষাধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হাছান শাহীন, অ্যাডভোকেট এ আর জুয়েল, সুরঞ্জিত গুপ্ত রঞ্জু প্রমুখ।
১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে জগৎজ্যোতি দাসের জন্ম। ছাত্রজীবনেই তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নের তেজদীপ্ত নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
একাত্তরের উত্তাল দিনে দেশমাতৃকার জন্য তিনি ছুটে যান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো ১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। তাঁর চৌকস নেতৃত্বে গঠিত হয় গেরিলা দল, ‘ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’। মুক্তিযুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে জগৎজ্যোতি উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গণে ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠেন। তাঁর ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষার পারদর্শিতার কারণে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয় এবং দাস পার্টি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ লাভ করে।
দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলির মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেওয়া এবং দিরাই-শাল্লায় কৌশলে ১০ জন রাজাকারের দলকে অস্ত্র ব্যয় ছাড়াই আটক করার মতো ঘটনা রয়েছে। তাঁর দল দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর, দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক মাস আগে মাত্র ২২ বছর বয়সে নিজের বাড়ির খুব কাছে ‘খইয়া গোপী’ বিলে বদলপুর অপারেশনে শত্রæর বুলেটে জীবনাবসান হয় এই বীরের। যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দলের অন্য সদস্যদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে জ্যোতি একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার মুহ‚র্তে তাঁর শেষ উচ্চারণ ছিল, ‘আমি যাইগা রে’।
জগৎজ্যোতির আত্মত্যাগের পর রাজাকাররা তাঁর দেহ আজমিরীগঞ্জ বাজারে একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে নির্যাতন চালায় এবং পরে ভেড়ামোহনা নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।
জগৎজ্যোতির এই অসীম সাহসিকতার সংবাদ সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের ঘোষণা দিলেও, পরে ১৯৭২ সালে তাঁকে বীরবিক্রম খেতাব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব এতই সুবিদিত ছিল যে ৪ নম্বর সেক্টরের সাব-কমান্ডার প্রয়াত মাহবুবুর রব সাদী বলেছিলেন, বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্য ছিলেন জগৎজ্যোতি।
এই বীর যোদ্ধার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে জাতি নতুন করে তাঁর অসম সাহসী দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করল সুনামগঞ্জবাসী।
জৈন্তা বার্তা/ ওয়াদুদ




